গর্ভপাতের পর মায়ের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিচ্ছেন তো?

গর্ভপাতের পর মায়ের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিচ্ছেন তো?

গর্ভপাত পরবর্তী সময়ে মায়ের যত্ন: শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা জরুরি

গর্ভপাত–পরবর্তী দিনগুলোতে মায়ের শরীর ও মনের বিশেষ যত্ন প্রয়োজন।

৩০ বছর বয়সে প্রথমবারের মতো সন্তান ধারণ করেছিলেন এনজিওকর্মী সায়রা মাহমুদ (ছদ্মনাম)। কোনো শারীরিক জটিলতা ছাড়াই তিনি প্রথম সন্তানের জন্ম দেন। কিন্তু চার বছর পর আবার গর্ভধারণ করলে নানা জটিলতার কারণে সাড়ে চার মাসের মাথায় তার গর্ভপাত হয়ে যায়।

এরপরই চারপাশের মানুষের আচরণ বদলে যেতে শুরু করে। পরিবারসহ পরিচিতজনদের অনেকে তার অফিস করা, গণপরিবহনে যাতায়াত কিংবা বাইরের খাবার খাওয়াকে দায়ী করতে থাকেন। অথচ প্রথম সন্তান ধারণের সময়ও তিনি একই জীবনযাপন করছিলেন এবং তখন কোনো সমস্যা হয়নি। গর্ভপাত–পরবর্তী দিনগুলো স্মরণ করে সায়রা বলেন, ‘তখন আমার নিজের শরীর-মনই বিধ্বস্ত ছিল। বড় মেয়েটার যত্নও নিতে পারছিলাম না। এর মধ্যে মানুষের এসব কথা শুনে মনে হতো গর্ভপাতের জন্য আমিই দায়ী। যেন আমি ইচ্ছা করে নিজের সন্তানকে হারিয়েছি। কী যে কষ্টের সময় ছিল তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না!’

সৌভাগ্যবশত, সায়রার স্বামী সবসময় তার পাশে ছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের অনেক নারী এই দুঃসময়ে স্বামীর কাছ থেকেও মানসিক সহায়তা পান না।

মিথিলা তাবাসসুম (ছদ্মনাম), একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা। গর্ভধারণের পর তিনি নিয়ম মেনে চলতেন, অফিসের গাড়িতে যাতায়াত করতেন, বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে যেতেন এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলতেন। তারপরও চতুর্থ মাসে তার গর্ভপাত হয়ে যায়।

ভীষণ অসুস্থতা আর দুর্বল শরীর নিয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে তিনি বুঝতে পারেন, তার স্বামীর আচরণ পরিবর্তিত হয়ে গেছে। তিনি মনে করছিলেন, মিথিলা যথেষ্ট যত্ন নেননি বলেই গর্ভপাত হয়েছে।

মিথিলা বলেন, ‘সেই মুহূর্তে কেউ আমাকে সান্ত্বনা দেয়নি, কেউ জিজ্ঞেসও করেনি আমি কেমন আছি। রাতের পর রাত আমি কেঁদেছি, কিন্তু আমার স্বামী আমার অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করেনি। সে শুধু আমাকে দোষারোপ করেছে। বলেছে, অন্যদের তো এত সহজে গর্ভপাত হয় না, আমার কেন হলো?’

গর্ভপাত–পরবর্তী সময়ে মায়ের মানসিক স্বাস্থ্য

এই প্রবণতা বাংলাদেশে অনেক পরিবারেই দেখা যায়। একজন মা যখন শারীরিক ও মানসিকভাবে ভীষণ দুর্বল থাকেন, তখন তার মানসিক সমর্থন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয়।

গর্ভপাতের পর মায়ের শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সন্তান হারানোর শোক তাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। এ সময় শুধু শারীরিক সুস্থতাই নয়, মানসিক যত্নও জরুরি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক লাইলুন নাহার বলেন, ‘গর্ভপাতের পর নারীরা পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেসে ভোগেন। তারা দুঃখ, আবেগ, অপরাধবোধ, রাগ, হতাশা অনুভব করতে পারেন। অনেকের আত্মবিশ্বাস কমে যায়, খাদ্যাভ্যাস বদলে যায়, ঘুমের সমস্যা হয় এবং তারা একাকিত্বে ভুগতে পারেন। এই সময়ে পরিবারের বিশেষ করে স্বামীর সহানুভূতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’

তিনি আরও বলেন, ‘কোনো মা–ই ইচ্ছে করে গর্ভপাতের মতো যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যান না। এটি নানা কারণে ঘটতে পারে। তাই এ সময় স্বামীকে সবচেয়ে বেশি সহানুভূতিশীল হতে হবে। এমপ্যাথি বা সমমর্মিতা দেখাতে হবে। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের তুলনায় স্বামীর মানসিক সমর্থনই মায়ের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।’

গর্ভপাতের পর নারীর শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য পরিবার ও স্বজনদের ইতিবাচক ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। দোষারোপ নয়, বরং সহমর্মিতা ও ভালোবাসা দিয়ে তাকে আগলে রাখার সময় এটাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published.