পানামা খালের বন্দর কিনছে ব্ল্যাকরক, যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অগ্রগতি
ক্ষমতায় আসার পর থেকেই পানামা খাল নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এবার সেই গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক পথের দুটি প্রধান বন্দরের নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানির হাতে যাচ্ছে। হংকংভিত্তিক মালিকের কাছ থেকে পানামা খালের দুটি প্রধান বন্দর কিনতে সম্মত হয়েছে মার্কিন বহুজাতিক বিনিয়োগ সংস্থা ব্ল্যাকরক। বিশ্লেষকদের মতে, এই চুক্তির ফলে বৈশ্বিক বন্দর ব্যবস্থাপনায় নতুন মেরুকরণ ঘটতে যাচ্ছে।
চীনা প্রভাব কমাতে যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ
ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হংকংভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সিকে হাচিসন প্রায় ২,২৮০ কোটি ডলারে বন্দরের সিংহভাগ শেয়ার বিক্রি করতে রাজি হয়েছে। মূলত, পানামা খালে চীনা প্রভাব নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের লাগাতার অভিযোগ ও কূটনৈতিক চাপে এই হস্তান্তর কার্যকর হতে যাচ্ছে।
চুক্তি অনুসারে, সিকে হাচিসন তাদের ব্যবসা ব্ল্যাকরক, গ্লোবাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার পার্টনার্স (GIP) এবং টার্মিনাল ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের (TIL) একটি কনসোর্টিয়ামের কাছে হস্তান্তর করবে। কোম্পানির বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, এই গোষ্ঠী পানামার দুটি বন্দরের ৯০ শতাংশ মালিকানা ও পরিচালনার দায়িত্ব পাবে।
যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত বিজয়
সমুদ্র বাণিজ্যের এই গুরুত্বপূর্ণ পথের মালিকানা পরিবর্তনকে যুক্তরাষ্ট্রের বড় কৌশলগত অগ্রগতি হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের (CSIS) আমেরিকাস প্রোগ্রামের পরিচালক রায়ান বার্গ বলেছেন, এই অধিগ্রহণ পানামা খালের নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিতর্কের অবসান ঘটাতে পারে এবং যুক্তরাষ্ট্র-চীন কৌশলগত প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রকে সুবিধাজনক অবস্থানে নিয়ে আসবে। রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “এই চুক্তি আমেরিকা মহাদেশে চীনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যুক্তরাষ্ট্রের বড় সাফল্য।”
ট্রাম্প প্রশাসনের প্রভাব
ট্রাম্প দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ করে আসছিলেন যে, পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ বেইজিংয়ের হাতে চলে যাচ্ছে। বছরের শুরুতেই তিনি হুঁশিয়ারি দেন, যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ এই জলপথ পুনরায় নিয়ন্ত্রণে নিতে পারে। ট্রাম্প প্রশাসন পানামাকে চীনা প্রভাব কমানোর জন্য চাপ দিতে থাকে এবং যুক্তি দেয় যে, বন্দরে চীনের সম্পৃক্ততা খালের নিরপেক্ষতাসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি লঙ্ঘনের শামিল।
শেয়ারবাজারে প্রভাব ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
সিকে হাচিসন আশা করছে, এই চুক্তি থেকে ১,৯০০ কোটি ডলারের বেশি অর্থ পাবে, যা শেয়ারহোল্ডারদের ঋণ পরিশোধে সহায়ক হবে। চুক্তির ঘোষণার পর হংকংয়ের পুঁজিবাজারে সিকে হাচিসনের শেয়ারের দাম ২২ শতাংশ বেড়েছে।
গত নভেম্বরে নির্বাচনের পর ট্রাম্প কানাডা, গ্রিনল্যান্ড ও পানামাকে যুক্তরাষ্ট্রের অংশ বলে দাবি করেছিলেন। এরপরই সিকে হাচিসন তাদের ব্যবসার ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু করে। চুক্তি আলোচনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তি জানান, “ট্রাম্প নির্বাচনে জয়ের পর যখন পানামার ওপর কৌশলগত দখলের কথা বলেন, তখন সিকে হাচিসন বুঝতে পারে এটি রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর এবং সেখান থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নেয়।”
বিশ্বব্যাপী বন্দর ব্যবসায় প্রভাব
সিকে হাচিসন বর্তমানে যুক্তরাজ্য, জার্মানি, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, মেক্সিকো ও অস্ট্রেলিয়াসহ ২৩টি দেশের ৪৩টি বন্দর পরিচালনা করে। নতুন এই চুক্তির ফলে শুধু পানামা খালের বন্দর নয়, সিকে হাচিসনের বৈশ্বিক বন্দর কার্যক্রমের একটি বড় অংশ ব্ল্যাকরক ও তার সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে চলে যাচ্ছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই চুক্তি বৈশ্বিক বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে এবং বন্দর ব্যবসায় এক নতুন মেরুকরণের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
Leave a Reply