বাংলাদেশি চিকিৎসক ও নার্সদের জন্য আয়ারল্যান্ডে ক্যারিয়ার তৈরির সুযোগ: তিনটি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে

বাংলাদেশি চিকিৎসক ও নার্সদের জন্য আয়ারল্যান্ডে ক্যারিয়ার তৈরির সুযোগ: তিনটি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে

আয়ারল্যান্ড উত্তর-পশ্চিম ইউরোপের একটি দ্বীপদেশ, যার রাজধানী ডাবলিন। এটি একটি সাংবিধানিক প্রজাতন্ত্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য। দেশটি কেল্টিক সংস্কৃতি, অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং উন্নত অর্থনীতির জন্য পরিচিত। অর্থনৈতিকভাবে আয়ারল্যান্ড বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ দেশ, যার প্রধান খাতগুলো হলো তথ্যপ্রযুক্তি, ফার্মাসিউটিক্যাল, আর্থিক পরিষেবা, কৃষি এবং পর্যটন। গুগল, অ্যাপল, ফেসবুকসহ অনেক আন্তর্জাতিক কোম্পানির ইউরোপীয় সদর দপ্তর এখানে অবস্থিত। এছাড়া, দেশটির দুগ্ধ এবং গবাদিপশু খাতও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির কারণে আয়ারল্যান্ড ইউরোপের অন্যতম ধনী দেশ হিসেবে পরিচিত।

বর্তমানে আয়ারল্যান্ডের স্বাস্থ্য খাত আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল, বিশেষ করে চিকিৎসক ও নার্সের সংকট মোকাবেলার জন্য। ২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, আয়ারল্যান্ডে কর্মরত চিকিৎসকদের প্রায় ৪০ শতাংশ বিদেশি, যা দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর তাদের নির্ভরশীলতার প্রমাণ। একই বছরের তথ্যমতে, নার্সিং কর্মীদের মধ্যে ৫১.৮ শতাংশ বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।

বাংলাদেশি চিকিৎসকদের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মেডিকেল ডিগ্রির স্বীকৃতি। আইরিশ মেডিকেল কাউন্সিল ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপাইন এবং মিসরের মেডিকেল ডিগ্রি সহজে স্বীকৃতি দেয়, কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি কঠিন। আয়ারল্যান্ডে স্থানীয় চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম থাকায় ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, মিসর, সুদান ও নাইজেরিয়ার মতো দেশ থেকে হাজার হাজার স্বাস্থ্যকর্মী কাজ করছেন। কিন্তু বাংলাদেশি চিকিৎসকের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক কম, এবং নার্সদের সংখ্যা প্রায় নেই বললেই চলে। যেসব বাংলাদেশি চিকিৎসক এখানে কাজ করছেন, তাদের বেশির ভাগ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে আসেন।

এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে: কেন ভারত, পাকিস্তান বা ফিলিপাইন থেকে আসা স্বাস্থ্যকর্মীরা সহজেই আয়ারল্যান্ডে কাজের সুযোগ পাচ্ছেন, অথচ বাংলাদেশিরা পিছিয়ে রয়েছেন? এর পেছনে কিছু কাঠামোগত এবং প্রশাসনিক কারণ রয়েছে, যা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশি চিকিৎসকদের জন্য মেডিকেল ডিগ্রির স্বীকৃতি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আইরিশ মেডিকেল কাউন্সিল (IMC) ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপাইন ও মিসরের মেডিকেল ডিগ্রির স্বীকৃতি দেয়, কিন্তু বাংলাদেশের জন্য এটি পাওয়া কঠিন। এর ফলে বাংলাদেশি চিকিৎসকদের অতিরিক্ত পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়, যা সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল। নার্সদের ক্ষেত্রেও একই ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। আয়ারল্যান্ডের নার্সিং বোর্ড (NMBI) ফিলিপাইন, ভারত এবং নাইজেরিয়ার নার্সদের স্বীকৃতি দেয়, কারণ তাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক চুক্তি রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো চুক্তি না থাকায় বাংলাদেশি নার্সদের জন্য আবেদন প্রক্রিয়ায় নানা জটিলতা সৃষ্টি হয়।

বাংলাদেশি চিকিৎসকদের আয়ারল্যান্ডে কাজ করতে হলে সাধারণত তিনটি প্রধান ধাপে পরীক্ষা বা মূল্যায়ন করতে হয়:

১. আইএমসি রেজিস্ট্রেশন: আইরিশ মেডিকেল কাউন্সিলে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে হয়, যা তাদের অভিজ্ঞতা এবং শিক্ষাগত যোগ্যতার ওপর নির্ভর করে।

২. প্রী-রেজিস্ট্রেশন পরীক্ষা (PRES): যদি ডিগ্রি স্বীকৃত না হয়, তবে PRES পরীক্ষা দিতে হয়, যার মধ্যে লিখিত পরীক্ষা, ক্লিনিক্যাল স্কিলস পরীক্ষা এবং সুপারভাইজড ইন্টার্নশিপ অন্তর্ভুক্ত থাকে।

৩. বিকল্প পথ: যদি কোনো ডাক্তার PLAB বা MRCP পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন, তবে তারা PRES পরীক্ষা ছাড়াই IMC রেজিস্ট্রেশন পেতে পারেন। স্পেশালিস্ট হিসেবে কাজ করতে চাইলে CESR (Certificate of Eligibility for Specialist Registration) বা সমমানের যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। তবে IMC রেজিস্ট্রেশন পাওয়ার জন্য ভাষার দক্ষতার পরীক্ষা (IELTS বা OET) বাধ্যতামূলক।

আয়ারল্যান্ডে কাজ করার জন্য চিকিৎসক এবং নার্সদের আইইএলটিএস বা ওটি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করা প্রয়োজন। IELTS-এ অন্তত ৭.০ স্কোর এবং OET-তে ‘বি’ গ্রেড প্রয়োজন। ভারত ও অন্যান্য দেশের চিকিৎসক এবং নার্সরা ইংরেজিতে শিক্ষা গ্রহণের কারণে সহজেই এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেন, কিন্তু বাংলাদেশের স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য এটি তুলনামূলকভাবে কঠিন।

এছাড়া, সরকারি পর্যায়ে আনুষ্ঠানিক চুক্তির অভাবও একটি বড় সমস্যা। ফিলিপাইন, ভারত, নাইজেরিয়া এবং সুদানের সঙ্গে আয়ারল্যান্ডের স্বাস্থ্যকর্মী সরবরাহের আনুষ্ঠানিক চুক্তি থাকায় তাদের চিকিৎসক ও নার্সরা সহজেই অনুমোদন পান। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তেমন কোনো চুক্তি না থাকায় তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছেন।

বাংলাদেশি স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো চাকরির সংযোগ বা স্পনসরশিপ পাওয়া। আয়ারল্যান্ডের হাসপাতালে সরাসরি আবেদন করতে হলে স্পনসরশিপ প্রয়োজন, যা বাংলাদেশিদের জন্য পাওয়া কঠিন। ভারত বা অন্যান্য দেশের জন্য নির্দিষ্ট কিছু রিক্রুটমেন্ট এজেন্সি রয়েছে, যারা হাসপাতালের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে, কিন্তু বাংলাদেশিদের জন্য তেমন কোনো এজেন্সি নেই।

এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলার জন্য বাংলাদেশকে বেশ কিছু কৌশলগত পদক্ষেপ নিতে হবে:

প্রথমত, সরকারকে আইরিশ মেডিকেল কাউন্সিল (IMC) এবং নার্সিং বোর্ড (NMBI) সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে।
দ্বিতীয়ত, সরকারি পর্যায়ে স্বাস্থ্যকর্মী সরবরাহের আনুষ্ঠানিক চুক্তি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তৃতীয়ত, IELTS এবং OET পরীক্ষার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
চতুর্থত, চাকরির সংযোগ ও স্পনসরশিপ পেতে নির্দিষ্ট কিছু রিক্রুটমেন্ট এজেন্সি তৈরি করা দরকার।

বাংলাদেশকে বিশেষায়িত চিকিৎসক তৈরি করার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। আয়ারল্যান্ডে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের চাহিদা রয়েছে, বিশেষ করে অ্যানেসথেসিয়া, কার্ডিওলজি, নিউরোলজি এবং সার্জারির ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ যদি এই ক্ষেত্রে বিশেষায়িত চিকিৎসকদের তৈরি করতে পারে, তাহলে তারা সহজেই আয়ারল্যান্ডের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারবেন।

আয়ারল্যান্ডে চিকিৎসক ও নার্সদের বেতন কাঠামো বেশ আকর্ষণীয়। একজন এন্ট্রি-লেভেলের চিকিৎসক বছরে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার ইউরো আয় করতে পারেন, যেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের আয় ১ লাখ ২০ হাজার থেকে ২ লাখ ইউরোর মধ্যে হয়ে থাকে। কনসালট্যান্ট চিকিৎসকদের বেতন আরও বেশি, যা ২ লাখ ১০ হাজার ইউরোর বেশি হতে পারে। নার্সদের জন্যও বেতন কাঠামো ভালো, এন্ট্রি-লেভেলে বছরে প্রায় ৩০ হাজার ইউরো থেকে শুরু হয় এবং সিনিয়র পর্যায়ে ৫৫ হাজার ইউরোর বেশি হতে পারে।

বাংলাদেশ যদি আয়ারল্যান্ডের স্বাস্থ্য খাতে প্রবেশের জন্য পদক্ষেপ নেয়, তাহলে চিকিৎসক ও নার্সদের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের সুযোগ তৈরি হবে, পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিও সমৃদ্ধ হবে। সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে বাংলাদেশ যদি প্রয়োজনীয় নীতি ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে এটি দেশের স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.